স্বদেশ ডেস্ক:
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন শেষে ফিরে গত শুক্রবার রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের দেয়া বক্তব্য নিয়ে কক্সবাজারের প্রতিটি আশ্রয় শিবিরে চলছে জোরালো আলোচনা। সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, প্রতিনিধিদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না তারা। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই বলছেন, প্রত্যাবাসনের ওপরেই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন ২৬ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম। অনেক বছর পর নিজের দেশ দেখার সুযোগে আপ্লুত হলেও নানা বিষয় নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে তার। তিনি বলেন, আমাদেরকে ক্যাম্পগুলো দেখিয়েছে। আমরা জানতে চাইলাম, ক্যাম্প কেন? তারা বলেছে ‘আপনাদের জন্য’। আমরা বলেছি, আমরা যদি সিকিউরিটি না পাই, নাগরিকত্ব কার্ড না পাই তাহলে কি হবে, তখন তারা জানিয়েছে এনভিসি কার্ড নিতে হবে। আমরা বলেছি এনভিসি কার্ড অতিথিদের জন্য, এনভিসি কার্ড নেওয়া
মানে আমরাও অতিথি বা মেহমানের মতো। এক্ষেত্রে আমরা কোনো জমির মালিক হতে পারব না, নাগরিকত্ব পাব না। আমরা দাবি করেছি আমাদের গ্রামে আমাদের ভিটাজমি ফিরিয়ে দিতে, তখন আমরা নিজেদের টাকায় ঘর তৈরি করে থাকব। আমাদের শেষ কথা হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, ভিটেমাটি না দিলে আমরা মিয়ানমার ফিরে যাবনা।
বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় দাবি আদায় করে মিয়ানমারে ফিরতে চান প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য সুফিয়ান। তবে এই মনোভাবের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না সব রোহিঙ্গা। টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানেও তো আমাদের কোনো অধিকার নেই, এমনি ভাসমান জীবনে কোনোমতে বেঁচে আছি। তার চেয়ে জন্মভূমিতে মরার সুখ অনেক বেশি। কেউ যাবে- কি না যাবে সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়, আমাদের ডাকলে আমরা মিয়ানমার ফিরবই।’
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, সবেমাত্র আমরা মিয়ানমারের মংডু ও এর আশপাশে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুতকৃত গ্রাম ও অবকাঠামো দেখে এলাম। দুই দেশের মধ্যে আরও আলোচনা হবে, আশা করছি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অগ্রগতি হবে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দাবি আদায়ের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, মিয়ানমারের আরাকানই আমাদের জন্য আসল জায়গা। যারা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও ভিটাজমির কথা বলছেন, তারা আসলে রোহিঙ্গাদের কথা ভাবছেন না। বাংলাদেশেও তো আমাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই, ভিটাজমি নেই। এক সময় নিরাপত্তা থাকলেও রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী তৎপরতায় এখন তাও নেই। তাহলে এদেশে যদি আমরা এসব কিছু ছাড়া থাকতে পারি, তাহলে জন্মভূমি মিয়ানমারে কেন নয়? তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কারণ তাদের উপর পুরো দুনিয়ার চোখ থাকবে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গিয়ে কোন অন্যায় করলে সেটি ইন্টারনেটের বদৌলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ক্যাম্পে কোন রোহিঙ্গাই নিরাপদ নয়। প্রতিটি ক্যাম্পে তৈরী হয়েছে আলাদা আলাদা দুষ্কৃতিকারী গোষ্ঠী। এখানেই রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ক্যাম্পে এখন প্রাণের নিশ্চয়তা নেই, কে কোন দিক থেকে এসে গুলি করে পালিয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে দেশে গিয়ে জন্মভূমির স্বাদ নিতে পারলে অনেক বেশি সুখ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ৬২ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। মিয়ানমার ওই তালিকায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে প্রাথমিক বাছাই করে। এর মধ্যে প্রথম দফায় এক হাজার ১৪০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার পাইলট প্রোগ্রাম হাতে নেই। ওই তালিকার রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসেন। তারা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্পে তালিকাভুক্তদের মধ্যে ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ফিরে যান। এরপর গত শুক্রবার ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে যায়।